بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
বিদায় হজ্বের ভাষন ১০ হিজরিতে অর্থাৎ ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হজ্ব পালনকালে আরাফাতের ময়দানে সর্বশেষ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মাদ ﷺ কর্তৃক প্রদত্ত খুৎবা বা ভাষন।জিল হজ্বের ৯ তারিখে আরাফাতের ময়দানে নামরা নামক স্থানে একটি গাঁধার পিঠে সওয়ার হয়ে এই খুৎবা প্রদান করা হয়।এই খুৎবায় কেয়ামত পর্যন্ত মানব জাতির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট দিকসনির্দেশনা ছিলো।এই খুৎবাকে মুসলমানেরা বিদায় হজ্বের ভাষন বলে থাকে।
বিদায় হজ্বের ভাষন একত্রে সংরক্ষন করা হয় নাই বিভিন্ন হাদিসের কিতাব থেকে যতটুকু সংগ্রহ করা গেছে ততটুকুই বিভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
বিদায় হজ্বের ভাষনের একটি তাৎপর্য আছে,এই ভাষনে মানব জাতির কল্যানের দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং কিভাবে মানুষ দুনিয়া আখেরাতের কল্যান প্রাপ্ত হবে সেই বিষয়েও দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
নিম্নে এই ঐতিহাসিক ভাষনটি তুলে ধরা হলো বিষয় ভিত্তিক ভাবে সাজিয়েঃ
মানুষের রক্ত,জান,মাল এবং পরকাল সম্পর্কে।
হে মানব মন্ডলী,তোমরা আমার কথা গুলু মন দিয়ে শ্রবন কর,কেননা এই বছরের পর এই স্থানে তোমাদের সাথে আর মিলিত হইতে নাও পারি।
আগত এবং অনাগতকালের হে মানব মন্ডলী,যতক্ষন পর্যন্ত তোমরা তোমাদের প্রভুর সাথে মিলিত না হচ্ছো তোমাদের রক্ত ও তোমাদের ধন-সম্পদ এই দিন ও এই মাসের মতই পবিত্র।
নিশ্চয় তোমরা তোমাদের প্রভুর সাথে মিলিত হবে যখন তোমাদের প্রভু তোমাদের কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন এবং আমি তোমাদেরকে তাঁর সংবাদ পৌঁছে দিয়েছি।
সামজিক কর্তব্য ও সম্পর্ক।
যে ব্যক্তি অন্যের ধন সম্পদের আমানতদার তার উচিত মুল মালিককে তার সম্পদ ফিরিয়ে দেয়া।
সুদের লেনদেন হারাম,তবে তোমাদের মুলধন তোমাদেরই থাকবে।কারও প্রতি অত্যাচার করবেনা এবং অত্যাচারিত হয়োনা।
আল্লাহর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুদ হারাম তাই আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের যে সমস্ত সুদ পাওনা রয়েছে তা সবি বাতিল ঘোষনা করা হলো।
অজ্ঞতার যুগে যে সকল খুন হয়েছে তার ক্ষতিপুরুন বাতিল করা হলো।
হে মানব মন্ডলী,শয়তান এদেশে পূজিত হওয়ার আশা ত্যাগ করেছে সে অন্য দেশে মান্য হবে।সুতরাং তোমরা তোমাদের ইমান(বিশ্বাস)সম্পর্কে সতর্ক থাকবে,যেন তোমাদের ভাল কাজগুলু অন্য কারো দ্বারা নষ্ট না হয়ে যায়।
হে মানব মন্ডলী,পবিত্র মাসের রহিত করন অন্ধকার যুগেরই ধারা।যারা অবিশ্বাস্য পছন্দ করে তারা বিভ্রান্ত।তারা বলে এক বছর পবিত্র মাস পরের বছর অপবিত্র,তারা আল্লাহ কর্তৃক পবিত্র মাসের সংখ্যা ঠিক রাখার জন্য পবিত্র মাসকে অবিত্র বলে।সময় ঘুরেছে যে দিন থেকে আসমান ও জমিন সৃষ্টি হয়েছে,আল্লাহ কর্তৃক মাসের সংখ্যা ১২টি এর মধ্যে ৪টি পবিত্র,৩টি পরপর এবং জমাদুউস সানি ও সাবানের মধ্যবর্তি মাস।
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক।
হে মানব মন্ডলী,তোমাদের স্ত্রীদের প্রতি যেমনি তোমাদের অধিকার রয়েছে তেমনি তাদেরও তোমাদের প্রতি অধিকার রয়েছে।ঐ ব্যক্তিই উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম।এইটা তাদের(স্ত্রীদের্)অবশ্য অকর্তব্য তাদের সতীত্ব রক্ষা করা এবং অশ্লীলতা ত্যাগকরা।যদি তারা(স্ত্রী গন)দোষী হয় তবে তাদের সাথে সহবাস(সঙ্গম)করোনা।তোমরা তাদের সংশোধনার্থে প্রহার কর যেন ক্ষত-বিক্ষত না হয়।যদি তারা অনুতপ্ত হয়(তওবা করে)তবে তাদের ক্ষেতে দাও পড়তে দাও এবং তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করবে।তোমরা একে অন্যকে উপদেশ দিবে তোমাদের স্ত্রী জাতির প্রতি ভাল ব্যবহার করার জন্য।কেননা তারা তোমাদেরই অংশ এবং তাদেরকে তোমরা আল্লাহর আমানত হিসাবে গ্রহন করেছ এবং আল্লাহর কালাম দ্বারাই তাদেরকে তোমাদের জন্য বৈধ করেছ।
ভবিষ্যৎ সম্পর্কে।
হে মানব মন্ডলী,তোমরা আমার কথাগুলু ভালভাবে অনুধাবন কর,যার জন্য আমি আমার কথাগুলু তোমাদের জন্য রেখে গেলাম।যদি তোমরা দুইটা জিনিসকে ভালভাবে আঁকড়ে ধর তাহলে তোমরা কোনদিনও পথভ্রষ্ট বা বিপদগামী হবে না।এক আল্লাহর পবিত্র ক্বোরান ও আমার সুন্নত।
হে মানব মন্ডলী,তোমরা আমার কথাগুলু ভাল করে অনুধাবন কর যেন নিশ্চিত করে বুঝতে পার।প্রত্যেক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই আর সকল মুসলমানই ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ।এইটা কোন মানুষের জন্যই বৈধ নয় যে বিনা অনুমতিতে সে অন্যের জিনিস গ্রহন করবে।সুতরাং কেউ কারো প্রতি অবিচার করবেনা।
দন্ডবিধি ও আনুগত্য।
একজনের অপরাধে অন্যজনকে দন্ড দেয়া যাবেনা।পিতার অপরাধে পুত্রকে এবং পুত্রের অপরাধে পিতাকে দায়ী করা যাবেনা।
যদি কোন নাক কান কাটা হাবসী কৃতদাসকেও তার যোগ্যাতার জন্য তোমাদের আমির(নেতা)করে দেয়া হয় তোমরা সর্বতোভাবে তার অনুগত থাকবে এবং তার আদেশ মান্য করবে।
ধর্ম সম্পর্কীয়।
সাবধান!ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ী করবে না।এই বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের পুর্ববর্তী অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।
মানুষ ও জাতি সম্পর্কে।
অনারবদের উপড় আরবদের এবং আরবদের উপড় অনারবদের কোন প্রাধান্য নাই।সমস্ত মানুষই এক আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে সৃষ্টি।সেই ব্যাক্তি আল্লাহর নিকট বেশী উত্তম যার তাকওয়া বেশী হবে।
জেনে রেখ,এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই তাই সমগ্র দুনিয়ার মুসলমান এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃ সমাজ।
শেষ নবী সম্পর্কে।
হে লোক সকল,শুনে রাখ আমার পরে আর কোন নবী আসবেনা।তোমাদের পর আর কোন উম্মত নাই।এ বছরের পর অয়তো তোমরা আর আমার সাক্ষাৎ পাবেনা,সুতরাং ওহী উঠে যাওয়ার আছে আমার নিকট যা শিখার শিখে নাও।
চারটি কথা স্বরন রেখো।শির্ক করবেনা,অন্যায় ভাবে মানুষ হত্যা করবেনা,চুরি করবেনা এবং ব্যভিচার করবেনা।
দাস দাসী এবং মুজুরের অধিকার।
হে মানব মন্ডলী,কোন দুর্বল মানুষের উপর অত্যাচার করবেনা,গরীবের উপর জুলুম করবেনা।অনুমতি ছাড়া কারো সম্পদ গ্রহন করবেনা,মুজুরের শরীরের ঘাম শুকানোর পুর্বেই তার মজুরী মিটিয়ে দিবে,তোমরা যা খাবে যা পড়বে তা তোমাদের দাস-দাসীদেরও খেতে ও পড়তে দিবে,যে মানুষ দাস-দাসীদের ক্ষমা করে দেয় ও ভালবাসে আল্লাহও তাদের ক্ষমা করেন ও ভালবাসেন।
বংশ পরিচয়ের বিষয়ে।
যে ব্যক্তি নিজ বংশের পরিবর্তে নিজেকে অন্য বংশের বলে প্রচার করে তার উপর আল্লাহ,ফেরেস্তা ও মানব জাতির অভিসম্পাত।
প্রকৃত মুসলমান কারা।
মুসলমান ঐ ব্যক্তি যার মুখ ও হাত থেকে অন্যরা নিরাপদ,ইমানদার ঐ ব্যক্তি যার হাতে সকল মানুষের ধন ও প্রান নিরাপদ।ঐ ব্যক্তি পুর্ন মুমিন হতে পারেনা যে দু-বেলা পেট পুর্ন করে আহার করে আর প্রতিবেশী অনাহারে থাকে,ঐ ব্যক্তিও মুমিন হবে পারেনা যখন সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে তা অন্যের জন্যও পছন্দ করেনা।
একতা বিষয়ে।
আমার উম্মতের মধ্যে যে ঝগড়া ও বিসংবাদ করতে বের হয় এবং প্রতিপক্ষের বুকে আঘাত করে,একত্রে খানা-পিনা করেনা আলাদা আলাদা ভাবে আহার করে(একতে আহার করার মাঝে বরকত নিহিত),যে ব্যক্তি বিভেদ সৃষ্টি করে তার স্থান জাহান্নামে।আমি তোমাদের পাঁচটি আদেশ করছিঃএকতা রক্ষা কর,নেতার অনুগত হও,প্রয়োজনে হিজরত কর,উপদেশ শ্রবন কর,আল্লাহর পথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ কর।
ঘুষ সম্পর্কে।
যাকে আমরা শাষন কার্যে নিযুক্ত করি আমরা তার ভরন পোষনের ব্যবস্থা করি এরপরেও যদি সে কিছু(অবৈধ ভাবে)গ্রহন করে তা বিশ্বাস ভঙ্গ বা ঘুষ বলে গন্য হবে এবং ঘুষ গ্রহন হারাম।
হিংসা-বিদ্বেষ সম্পর্কে।
তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ ত্যাগ কর,কেননা আগুন যেমন জ্বালানী বস্তুকে ভষ্মীভুত করে তেমনি হিংসা-বিদ্বেষ মানুষের সৎ কাজ গুলুকে ধবংস করে দেয়।
পরিশ্রমী ও ভিক্ষুক বিষয়ে।
যে ব্যক্তি নিজ হাতের কোন কাজ দ্বারা খাদ্য সংগ্রহ করে তা অপেক্ষা উত্তম খাদ্য আর নাই।তোমাদের মধ্যে যে ভিক্ষা করে সে যদি একগাছি রশি নিয়ে পিঠে কাঠের বোঝা বহন করে বিক্রি করে,আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেন এবং এইটাই তার জন্য উত্তম।
আমল নামা বিষয়ে।
তোমাদের প্রত্যেকেই আল্লাহর সম্মুখে হাজির হতে হবে এবং আপন আপন ভাল ও মন্দ কাজের হিসাব নিকাশ পাঠ করতে হবে।তোমরা সাবধান সেইদিন কেউ কাউকেও সাহায্য করতে পারবেনা।
জ্ঞান বিষয়ে।
তোমরা জেনে রেখো বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের অপেক্ষা মুল্যবান,যে জ্ঞানের পথে পরিভ্রমন করে আল্লাহ তাকে জান্নাতের পথ দেখান,জ্ঞান অনুসন্ধান কর,(দ্বীনের)জ্ঞানার্জন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ।
ব্যবহার বিষয়ে।
সমাজে তোমর আচরন ঐরূপ হবে যেমন আচরন তুমি অন্য থেকে কামনা কর বা যেরূপ ব্যবহার পেলে তুমি নিজেও খুশি হও
পিতা-মাতা সম্পর্কে।
হে মানববৃন্দ,তোমরা জেনে রাখো তোমাদের মাতা-পিতার সন্তষ্টিই আল্লাহর সন্তুষ্টি।মাতা-পিতার অসন্তুষ্টিই আল্লাহর অসন্তুষ্টি।তোমাদের জান্নার তোমাদের মাতা-পিতার পায়ের নিচে।